ফিকহুস সিয়াম(হানাফি মাযহাব অনুসারে)

ক্লাস নোটঃ

ফিকহুস সিয়ামঃ (হানাফি মাযহাব অনুসারে)

শাইখ আব্দুর রহমান হাফি.

 

চাঁদ দেখা সংক্রান্তঃ 

হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন,

তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে ঈদ করো। কিন্তু যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে গণনায় ৩০ পূর্ণ করে নাও।

(বুখারি, হাদিস : ১৯০৯; মুসলিম, হাদিস : ১০৮১)

*সাহাবীদের ব্যক্তিগত আমল(যেমন হযরত ওমর রাঃ শাবান মাসের ৩০ তারিখেও সিয়াম পালন করছেন) সবসময় শরিয়তে ধর্তব্য হয় না।

*শাবানের শেষদিন (অর্থাৎ ৩০ তারিখ) সন্দেহবশত রোজা রাখা যাবে না।

ইসলামি খিলাফায় চাঁদ দেখাঃ

• তিরমিযী, মুসলিম শরীফে এসেছে, ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, উম্মে ফজল নামক একজন মহিলার গোলাম কুরাইবকে শাম দেশে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে সে সবাইকে জানায় ঈদের চাঁদ দেখা গিয়েছে, হযরত মু’আবিয়া (রাঃ) তাদেরকে রোজা না রাখার অনুমতি দিয়েছেন। তাই তারা রোজা ভেঙে ফেলেছে। এটা শুনে ইবনে আব্বাস রা রোজা ভাঙ্গেননি, কারণ উনারা তখনও চাঁদ দেখেননি।

• ইসলামি খিলাফাহ পৃথিবীতে দ্বিখণ্ডিত করেননি, এটা ব্রিটিশদের প্রচলিত রীতি।

• ইসলাম সীমানার ভিত্তিতে ভূখন্ড ভাগ করেনি। বরং চাঁদ উদয়-অস্ত যাওয়ার ভিত্তিতে সীমানা বিভক্ত করে। সৌদি আরব-বাংলাদেশ একই ভূখণ্ডে নয়।

• যেসকল এলাকার চাঁদ উদয়-অস্ত একই সময়ে হয়(অল্প কয়েক ঘন্টার(২/৩) ব্যবধানে, যেমন; ভারত-বাংলাদেশ), সেসব এলাকায় সিয়াম পালনের বিধান একই।

যেমন- ভারত বা নেপালে চাঁদ দেখা গেলে বাংলাদেশের মানুষের উপর সিয়াম পালন ওয়াজিব হয়ে যাবে।

• তবে সময়ের পার্থক্য অনেক বেশি অর্থাৎ রাত-দিন সমান হলে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।

‌যেমন- সৌদি আরব, মদিনা, আমেরিকায় চাঁদ দেখার ভিত্তিতে বাংলাদেশে সাওম পালন করা যাবে না।

• অনেক সময় দেখা যায় (চাঁদ দেখা কমিটির ক্ষেত্রেও), সরকার কর্তৃক চাপের কারণে ওলামায়ে কেরামগণ বিভিন্ন ফতোয়া দিতে বাধ্য হয় ‌। এক্ষেত্রে ব্যক্তি যদি সঠিক বিষয়ে অবগত থাকে, তাহলে তিনি নিজের আমলের ব্যাপারে সচেতন থাকবে। ইন শা আল্লাহ্ এক্ষেত্রে এরকম ফতোয়া প্রদানের জন্য ওলামায়ে কেরামগণ গোনাহগার হবেন না, গোনাহগার হবে তারা যারা চাপপ্রয়োগ করেছে।

• বিভিন্ন সময় দূরবীন, ইউটিউব বা অন্য কোনো বিশ্বস্ত মাধ্যমে চাঁদ দেখা জায়েজ আছে।

• তবে প্লেন দিয়ে চাঁদ দেখা নিষেধ করা হয়েছে। কারণ এতে অন্য দেশের চাঁদ দেখার সম্ভাবনা রয়েছে।

সিয়ামের শর্তঃ

সিয়ামের শর্ত ৮টি। যথা-

১। মুসলিম হওয়া।

* মাসআলাঃ কোনো মুসলমান ব্যক্তি রোজারাখা অবস্থায় কোনো কুফরী কথা বলে কাফের বা মুরতাদ হয়ে গেলে, ইফতারের আগে তওবাহ করলে তার রোজা কি হবে?

উত্তরঃ- হানাফি মাযহাবের মতে তার রোজা হয়ে যাবে।

কোনো নওমুসলিম ইফতারের পর ইসলাম গ্রহণ করে পরদিন রোজা রাখলে তার রোজা কি হবে?

উত্তরঃ- হবে। কারণ সে মুসলমান হয়ে গেছে।

২। বালেগ হওয়া।

• ১০ বছরের বাচ্চাদের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। এর নিচের বাচ্চা (৭ বছর বা কম) ইচ্ছে হলে রোজা রাখবে, ইচ্ছে নাহলে রাখবেনা।

• নারী সাহাবিরা তাদের সন্তানদের রোজা রাখার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন।

* মাসআলাঃ কোনো বাচ্চা ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সাথে সাথে বালেগ হয়েছে। সে রোজা রাখলে কি রোজা হবে?

উত্তরঃ-হবে।

• ইসলামের বিধান ফজর ওয়াক্তে শুরু হয়।

৩। আকল হওয়া।

– বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া, মেধা থাকা।

* মাসআলাঃ কোনো ব্যক্তি রাতে রোজার নিয়ত করে ঘুমিয়েছে, সে ঘুম থেকে উঠেছে একদম দুপুরে বা ইফতারের সময়। এক্ষেত্রে এই ব্যক্তির রোজা হবে কি?

উত্তরঃ- হবে। কারণ সে ঘুমিয়েছিল। লম্বা সময় ঘুম আর অচেতন হওয়া এক বিষয় নয়।

* মাসআলাঃ কোনো ব্যক্তি নিয়ত করে রোজা রাখার পর অচেতন হয়ে গেছে। তার চেতনা এসেছে ইফতারের পর। এই ব্যক্তির রোজা কি হয়েছে?

উত্তরঃ- না। কারণ সে পূর্ণ করেনি। সাহরী-ইফতার দুটোই করতে হবে।

৪। রোজার ইলম থাকতে হবে।

৫। সুস্থ থাকা। 

অসুস্থতা- ঔএ্যাজমা রোগী।

কোনো ব্যক্তি বড় কোনো অসুস্থতা থেকে সেরে উঠেছে, রোজা রা উচ্চখলে তার আবার অসুস্থ হওয়ার ধারণা প্রবল- এমন ব্যক্তির জন্য রোজা রাখা জরুরী নয়।

• অসুস্থতার ৩ অবস্থাঃ-

১. রোজা রাখলে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ধারণা প্রবল

২. রোজা রাখলে শরীর দুর্বল হয়ে যাবে, ক্লান্ত হয়ে যাবে তবে বিশেষ কোনো ক্ষতি হবে না

৩. রোজা রাখলে মনে হয় অসুস্থ হতে পারে, তবে নিশ্চিত না – এরকম হলে রোজা রাখতে হবে।

* একজন ব্যক্তি অর্ধেক দিন রোজা রাখতে পারে‌। বাকি সময়টুকু আর রোজা রাখতে পারে‌না।‌‌‌‌‌ এমন ব্যক্তির জন্য অর্ধেক রোজা রাখলে রোজা হবে কি?

উত্তরঃ- না, হবে না। কারণ রোজা হওয়ার শর্ত হচ্ছে সাহরী-ইফতার দুটোই করতে হবে

** গর্ভবতী নারী ও দুধপান করায় এমন নারীর জন্য আল্লাহ্ সিয়ামের ছাড় দিয়েছেন। তারা ইচ্ছা হলে রোজা রাখবে, ইচ্ছে না হলে রোজা রাখবে না।

৬। মুকিম হওয়া।

মুসাফির না হওয়া।

* সফরাবস্থায় রোজা রাখা জরুরী নয়। এটা ব্যক্তির ইখতিয়ারের মধ্যে পড়ে।

*মাসআলাঃ কোনো ব্যক্তি যশোর থেকে ঢাকায় প্লেনে আসবে। এ যাত্রায় তার কোনোপ্রকার কষ্ট হবেনা। এরকম ব্যক্তি রোজা না রাখলে গুণাহ হবে কি?

উত্তরঃ- না, গুণাহ হবে না। কারণ তিনি সফরাবস্থায় আছেন।

৭। হায়েজ-নেফাস অবস্থায় মহিলাদের জন্য রোজা রাখা জরুরী না।

হানাফি মাযহাবের মতে, হায়েজ সর্বনিম্ন ৩ দিন। নেফাস সর্বোচ্চ ৪০ দিন।

৮। রোজার নিয়ত করা।

খাবার, পানি, স্ত্রী সহবাস- এই ৩ জিনিস ত্যাগ করতে হবে।

* ভুলবশত খাবার বা পানি খেয়ে ফেললে রোজা হয়ে যাবে।

** হানাফি মাযহাবের মতে, মুখ-নাক-পশ্চাৎদেশ দিয়ে খাবার প্রবেশ করলে রোজা ভেঙে যাবে।

অন্যান্য মাধ্যমে (যেমন-খাবার স্যালাইন শরীরে প্রবেশ করানো) রোজা ভাঙ্গবে না- হানাফি মতানুসারে।

* ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, হিজামা করানোর দ্বারা রোজা ভেঙে যাবে।

* অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হলে রোজা ভাঙ্গবে না।

**থুথু খাওয়া- ওলামায়ে কেরামগণের মতে মাকরুহ।

প্রশ্নঃ ইনহেলার নিলে রোজা ভাঙ্গবে কি?

উত্তরঃ- ভাঙ্গবে। কারণ এটার ভেতরে থাকা লিকুইড শ্বাসনালীর ভেতরে চলে যায়।

প্রশ্নঃ রোজা রেখে দাঁত ব্রাশ করলে রোজা ভাঙ্গবে কি? টুথপেস্টের স্বাদ যদি মুখে পাওয়া যায়।

উত্তরঃ- না, ভাঙ্গবে না। কারণ হানাফি মাযহাবের মতে, খাবার বা পানি কন্ঠনালিকে অতিক্রম করতে হবে।

 

প্রশ্নঃ দাঁতে আটকে থাকা খাবার টুকরা বের করে খেলে রোজা ভাঙ্গবে কি?

উত্তরঃ- সকল ওলামায়ে কেরামের মতে, খাবার যদি দানার চেয়ে ছোট হয় তাহলে ভাঙ্গবে না। দানার চেয়ে বড় হলে ভেঙে যাবে।

কাযাঃ একটা জিনিসের পরিবর্তে অন্য জিনিস আদায় করা (অন্য যেকোনো সময়)।

* হস্তমৈথুন করলে রোজা ভেঙে যাবে। এর জন্য কাযা রোজা করতে হবে।

কাফফারাঃ আদায়ও করতে হবে, জরিমানাও দিতে হবে।

ফিদিয়াঃ বদলা দেওয়া।

* রোজা এমন একটি বিধান যা ক্ষেত্রবিশেষে দেরিতে পালন করাও জায়েজ আছে।

**আল্লাহ্ ওয়াদা করেছেন, মুত্তাকী বান্দাদের আমল কবুলের ব্যাপারে।

* কাযা রোজা আগে আদায় করে নিতে হবে। হানাফি মাযহাব মতে, জরুরী না, অন্য মাযহাবে জরুরী।

রোজার কাফফারাঃ

* রোজা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করলে।

কাফফারাঃ-

১. ১ জন গোলাম আজাদ।২

২. এতিম-মিসকিনদের খাবার খাওয়ানো।

৩. ১টি রোজার পরিবর্তে ৬০টি রোজা রাখা।

 

প্রশ্নঃ কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত খাবার খেলে বা হস্তমৈথুন করলে কাফফারা দিতে হবে কি?

উত্তরঃ হানাফি মাযহাব মতে, কাফফারা দিতে হবে।

অন্যান্য মাযহাব মতে, দিতে হবে না। কারণ হাদিসে রোজার কাফফারা হিসেবে শুধুমাত্র স্ত্রী সহবাসের কথা উল্লেখ আছে।

ফিদিয়াঃ বদলা দেওয়া।

কোনো ব্যক্তি বর্তমানে রোজা রাখতে পারে‌না এবং ভবিষ্যতেও কোনোদিন রোজা রাখতে পারবেনা, এরকম ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া জায়েজ।

প্রশ্নঃ কোনো ব্যক্তি অসুস্থতার কারণে পরবর্তী ২ বছর রোজা রাখতে পারবেনা। এরকম ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া জায়েজ কি?

উত্তরঃ- না। কারণ উনি ২ বছর পর রোজার পরিবর্তে রোজা রাখতে পারবেন।

প্রশ্নঃ বালেগ হয় কত বছর বয়সে?

উত্তরঃ হানাফি মাযহাব মতে, ছেলেদের সর্বোচ্চ ১৫ বছর, মেয়েদের সর্বোচ্চ ১৩ বছর(চূড়ান্ত নয়)। স্থান, কাল, পাত্রভেদে এটা ভিন্ন হয়।

 

Shopping Cart
Scroll to Top